
শিক্ষার নামে কিন্ডারগার্টেন জটিলতার শেষ কোথায় ?
সারাদেশে কিন্ডারগার্টেন ও সমমনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ৫৩ হাজার



প্রাথমিক শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষা বা বিকল্প শিক্ষা হিসেবে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রচলন হয়েছে বহু আগে। তারপর মাধ্যমিক ও অন্যান্য পর্যায়েও প্রাইভেট শিক্ষার প্রচলন শুরু হয়। হয়তো উদ্দেশ্য মহৎ ছিলো। কিন্তু এখন তা একপ্রকার ভয়ানক অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ত্রুটি, অনিয়ম, অভিযোগ, দুর্নীতি বলে শেষ করা যাবে না। ব্যাঙের ছাতার মতো সারাদেশের অলিতে-গলিতে গড়ে উঠেছে এসব কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বিশেষ করে বড় শহরগুলোতে এবং রাজধানী ঢাকায় এসব সংখ্যা গুনে শেষ হবে না। কিন্ডারগার্টেন সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায়শই নানান অভিযোগ আমাদের চোখে পড়ে। এখন নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে কোথায় কিন্ডারগার্টেন শব্দ ব্যবহার করা যাবে, আর কোথায় যাবে না – তা নিয়ে।
অবশ্য কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠানে অভিভাবকবৃন্দ কেনোইবা যাবেন না ? কিন্ডারগার্টেন ছাড়া বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অত্যধিক টাকা আদায়সহ নানাবিধ জটিলতার কারণেই তারা বিকল্প খুঁজতে থাকেন। এরই সুযোগ নিয়ে হাজারো কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এখন সেই কিন্ডারগার্টেনেও একই অবস্থা। তাহলে সাধারণ পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য কোথায় যাবেন ?
প্রসঙ্গত, স্কুলের নামের সঙ্গে কিন্ডারগার্টেন থাকবে নাকি কেবল বেসরকারি স্কুল লিখতে হবে সে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে খোদ শিক্ষককুল। এই অবস্থায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগের প্রণীত ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিধিমালা ২০২৩’ সংশোধনের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অ্যাসোসিয়েশন। তারা বলছেন, ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নয়, ‘কিন্ডারগার্টেন’ নামেই নিবন্ধন চান তারা। ফলে বিধিমালা চূড়ান্ত হওয়ার আগে অবশ্যই বিষয়টি সুরাহা হওয়ার দরকার আছে। যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর বলছে, এটা নিয়ে তারা কেন আন্দোলন করছেন জানি না। তাদের স্কুলগুলো বেসরকারি, সেটা নিয়ে তো কোনও তর্ক নেই। ফলে বেসরকারির নিয়মের মধ্যে তারা পড়বে। এখানে নামের সঙ্গে কিন্ডারগার্টেন শব্দটা থাকবে বা থাকবে না সেটা নিয়ে আলাপ নেই।
গত রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা। তাদের দাবি, কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠানগুলো কিন্ডারগার্টেন স্কুল নামে নিবন্ধন করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগবিধি শিথিল করতে হবে অথবা শিক্ষকদের বেতন সরকারি তহবিল থেকে প্রদান করতে হবে।
নেতারা আরও বলেছেন, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। এরমধ্যে প্রায় আড়াই কোটি শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। বিশেষ করে ৫৩ হাজার কিন্ডারগার্টেনে প্রায় ৮ লাখ শিক্ষক। প্রায় ৪০ লাখ পরিবার এ সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। নির্বাচনের আগে তাড়াহুড়ো করে নীতিমালা চূড়ান্তের কাজটি না করতে আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি।
কেন স্কুলের নামের শেষে কিন্ডারগার্টেন চান প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম খন্দকার গণমাধ্যমে বলেন, কিন্ডারগার্টেন শিশুদের প্রাক-বিদ্যালয় বা বিদ্যালয়-পূর্ব উপযোগী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিশেষ। এটি একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে শিশুদের বাগান।
‘কিন্ডারগার্টেন’ শব্দটি বিখ্যাত জার্মান শিশু-শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল কর্তৃক সৃষ্ট হয়েছে। এটি কেবল একটি স্কুল না। শিশুদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয় পর্যন্ত যাওয়া, খেলা ও প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এটা একটা শিক্ষা ব্যবস্থা। বেসরকারি বিদ্যালয়ের যে বিধি হচ্ছে সেখানে এমন কিছু বিষয়ের উল্লেখ আছে, যা কিন্ডারগার্টেনের যে আবহ তা ব্যাহত করবে। আমরা চাই বেসরকারি লেখা থাকলেও কিন্ডারগার্টেন শব্দটা যেন থাকে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ৫৩ হাজারের বেশি ব্যক্তিমালিকানাধীন কিন্ডারগার্টেন ও সমমনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সামান্য বেতন নিয়ে ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ প্রণীত ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিধিমালা ২০২৩’-এর মধ্যে এমন অনেক শর্ত আছে, যা আমাদের পক্ষে পূরণ সম্ভব না।
তবে ইতোমধ্যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর মধ্যে অনেক স্কুল বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নীতিমালা-২০১১ পালন করেছে। কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ৬৫০টি নিবন্ধন পেয়েছে। অন্যদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেন প্রতিষ্ঠান ৮০ হাজারেরও বেশি। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ৩০ হাজার প্রতিষ্ঠান। এরমধ্যে এখন পর্যন্ত স্মারক পেয়েছে ১০ হাজারেরও কম প্রতিষ্ঠান। আবেদন করেও নিবন্ধন না পাওয়া নিয়ে আছে নানা ক্ষোভ। আবেদন করেছে এমন এক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার আইন করেছে, সেই আইন মেনে আমাদের নিবন্ধন করতে হবে। আমরা আবেদনও করেছি কিন্তু নিবন্ধন পাইনি। নিবন্ধন না পাওয়ার কারণও আমাদের জানানো হয়নি। আমাদের পরে আবেদন করেছে এমন অনেকে আগে নিবন্ধন পেয়েছে।
এদিকে এসব বিভ্রান্তির কারণ জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত একটি গণমাধ্যমে বলেন, যে নামেই ডাকুক- স্কুলগুলো বেসরকারি। সেটা নিয়ে কনফিউশনের (বিভ্রান্তি) কোনও জায়গা নেই। কিন্ডারগার্টেন হোক বা অন্য যেকোনও নাম হোক, সেটা মুখ্য বিষয় নয়।
কিন্তু অভিভাবকদের অভিযোগ, কিন্ডারগার্টেন নাম থাকবে কি থাকবে না, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। বিভিন্ন স্কুলে যে পরিমাণ শিক্ষা বাণিজ্য হচ্ছে, সেটার দিকে আপনারা নজর দেন। আমরা সাধারণ পরিবারগুলো এসব নাটকে অতিষ্ঠ। আমরা চাই কম খরচে, কম অত্যাচারে বাচ্চাদের জন্য একটা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কথিত কিন্ডারগার্টেন সহ সকল স্কুলেই ডাকাতি করে টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। আমরা এসব নৈরাজ্য থেকে মুক্তি চাই।
