
নতুন শিক্ষা কারিকুলামে রয়েছে নানা বিতর্ক, ক্ষোভে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চাচ্ছেন না অনেক অভিভাবক
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিতর্কিতভাবে তুলে ধরা হচ্ছে



বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। একসময় বাংলাদেশের কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীকরণে যায়গা পেলেও তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে। একেক সময় একেক পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়েছে উত্তম বিকল্প নির্দিষ্টকরণের লক্ষ্যে। কিন্তু সমালোচনা যেনো পিছুই ছাড়ছে না। এর মধ্যে শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে নতুন কারিকুলাম। যা নিয়ে সারাদেশব্যপী চলছে তুমুল প্রতিবাদ।
সন্তাদনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন সচেতন অভিভাবক সমাজ শুরু থেকেই এই শিক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছে। জেলা ও বিভাগীয় শহর, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন স্কুলের সামনে অভিভাবক সমাবেশ চলমান রয়েছে। এমনকি পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করার পাশাপাশি আন্দোলন আরও জোড়ালো হচ্ছে। তবে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এই কারিকুলামের পক্ষেই যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছেন।
সন্তানদের ভবিষ্যৎ রক্ষার্থে নতুন কারিকুলাম বাতিলসহ সুনির্দিষ্ট ৮ দফা দাবি নিয়ে গত ১০ই নভেম্বর, শুক্রবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের নানাবিধ যৌক্তিক দাবিগুলো সামনে এনে গুটিকয়েক গণমাধ্যম ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করলেও বেশিরভাগ গণমাধ্যমই তা বিতর্কিতভাবে প্রচার করছে।
নাম পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কয়েকজন শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটি দেশের প্রধান মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। সেই শিক্ষা যদি মানসম্মত না হয়, বরং বিতর্কিত হয়। তাহলে সেই দেশ কখনোই আগাতে পারবে না। ইতোমধ্যে আমরা তার পরিলক্ষিত দিকও টের পাচ্ছি। দিন দিন আমাদের শিক্ষার মান একেবারে নিম্নমুখী হয়ে যাচ্ছে।’
তারা আরো বলেন, ‘নতুন কারিকুলাম বাতিলসহ যেসকল দাবি নিয়ে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন কাজ করছে- তা সম্পূর্ণ যৌক্তিক। অথচ কিছু মিডিয়া তার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানোর জন্য বিন্দুমাত্রও লজ্জিত হচ্ছে না। এটা সত্যিই আমাদের জন্য হতাশার। কারণ আপনারা গণমাধ্যম সত্যের কথা বলেন, আপনারা সমাজের বিবেক। অথচ আপনারা যদি এমন দ্বিমুখিতা আচরণ করেন, তা সত্যিই কষ্টের।’
নতুন কারিকুলাম বাতিল, নম্বরভিত্তিক লিখিত পরীক্ষা চালু, নবম শ্রেণিতে বিভাগ বিভাজন রাখাসহ ৮ দফা দাবিতে ওই সংবাদ সম্মেলনে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ে শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরাম তাদের যুক্তি ও বাস্তবতা তুলে ধরে।
সংবাদ সন্মেলনে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক রাখালা রাহা, সংবাদ স্যাটেলাইট লিমিটেডের সম্মানিত চেয়ারম্যান জনাব মোঃ শাহ আলম খান ও বিভিন্ন অভিভাবক ও বক্তারা তাদের নিজ নিজ অভিজ্ঞতা ও যুক্তি তুলে ধরেন।
শিক্ষাবিদ রাখাল রাহা তার লিখিত বক্তব্যে নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল, নম্বরভিত্তিক দুটি সাময়িক লিখিত পরীক্ষা চালু, বিষয় নির্বাচনের সুযোগ অথবা বিজ্ঞান বিভাগ রাখা, গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি, ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন, তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করা, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা বহাল রাখার দাবি জানান।
একই সঙ্গে সব শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রীপরিষদ ও সংসদে উত্থাপনের দাবি জানান।
তারা বলেন, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজসহ নানাবিধ চিহ্ন বাতিল করে পূর্বের ন্যায় নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি করা হোক। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন এই কারিকুলামটি এ দেশের জন্য অনুপযুক্ত। নতুন এই কারিকুলাম সংস্কার করে অন্তত ৫০/৬০ নম্বরে দুই সাময়িক লিখিত পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, নম্বর ও গ্রেডভিত্তিক মূল্যায়ন করা হোক। প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে রেজিস্ট্রেশন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল, স্কুল পিরিয়ডে সমস্ত প্রজেক্ট সম্পন্নকরণ এবং সমস্ত ব্যবহারিক ব্যয় স্কুলকে বহন করার দাবি জানান তারা।
বক্তারা আরো বলেন, এই কারিকুলাম অনুযায়ী নবম শ্রেণিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভাগ বা বিষয় বেছে নেওয়ার সুযোগ আর থাকছে না। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান মিলিয়ে একটি বিজ্ঞান বই এবং উচ্চতর গণিত ও গণিত মিলিয়ে একটি গণিতে বই সবার পাঠের জন্য বানানো হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এখন আগের চেয়েও কম বিজ্ঞান ও গণিত শিখবে এবং আমাদের আশঙ্কা তারা উচ্চশিক্ষায় গিয়ে ব্যর্থ হবে।
তারা বলেন, এই কারিকুলামে সাময়িক পরীক্ষার মতো লিখিত পরীক্ষা নেই। রয়েছে প্রতিদিনের শেখার মূল্যায়ন এবং সামষ্টিক মূল্যায়নের নামে রয়েছে দলগত কাজ, প্রজেক্ট বা এ্যাসাইনমেন্ট। এগুলো কীভাবে করতে হবে তার কিছুই শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারছে না, শিক্ষকও বুঝতে পারছেন না। এক-এক সময়ে এক-এক রকম নির্দেশনা আসছে। অপর্যাপ্ত শিক্ষক আর ঘিঞ্জি ক্লাসের মধ্যে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী নিয়ে ক্লাস বা মূল্যায়ন কিছুই সঠিকভাবে হচ্ছে না। ফলে অভিভাবকদেরও বাড়তি টাকা ও সময় ব্যয় হচ্ছে।
অভিভাবকরা বলেন, এখন ফলাফল নির্ধারণ হবে শুধু চিহ্ন পদ্ধতিতে, অর্থাৎ ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত নির্দেশ করে। এগুলোতে শিক্ষার মানের কি উন্নতি হয় আমরা জানি না, বরং জটিলতা তৈরি করছে। এর ফলে অনেক স্কুলে অনৈতিক চর্চা ও দুর্নীতি বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা হতাশ হচ্ছে এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে।
তারা বলেন, এই কারিকুলাম ও পাঠ্যবইয়ে কী আছে তার চেয়ে বড় বিষয় হলো, কী হচ্ছে বা কী ঘটছে। এই কারিকুলামের ফলে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, তাদের সঙ্গে তাদের অভিভাবক এবং শিক্ষকরাও চরম নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছেন। আমরা এ অবস্থা থেকে রেহাই চাই।
সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের ৮ দফা দাবিঃ
১.শিক্ষানীতি বিরোধী নতুন কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে।
২.নম্বারভিত্তিক ২টা সাময়িক লিখিত পরীক্ষা (৬০ নাম্বার) চালু রাখতে হবে এবং ফ্রাসটেস্টগুলোকে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (৪০ নাম্বার) হিসাবে ধরতে হবে।
৩.নবম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ অথবা বিজ্ঞান বিভাগ রাখতে হবে।
৪.ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুৰ্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করে নাম্বার ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে।
৫.শিখন ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সব প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে হবে।
৬.শিক্ষার্থীদের দলগত ও প্রজেক্টের কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে।
৭.প্রতি বছর প্রতি ক্লাসে নিবন্ধন ও সনদ প্রদানের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালু রাখতে হবে এবং এসএসসি ও এইচএসসি ২টা পাবলিক পরীক্ষা বহাল রাখতে হবে।
৮.সব সময়ে সব শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রী পরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।
সংবাদ সন্মেলেন তারা আগামী ১৪ নভেম্বর সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সারাদেশের সব স্কুলের সামনে অভিভাবক সমাবেশ ও ডিসি বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ও ২৪ নভেম্বর সকাল ১০টায় শহীদ মিনারে অভিভাবক সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা দেন।
