মিঠে কড়া সংলাপ শুদ্ধ মন অশুদ্ধ কাজ করতে পারে না

১ জানুয়ারি, ২০২২ | ৮:১০ পূর্বাহ্ণ
ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন , দৈনিক বাংলাখবর প্রতিদিন

একজন মানুষ তার দেহ ও মনের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারলে অর্থাৎ নিজেকে জানতে পারলেই কেবল সে বুঝতে পারত তার কামনা-বাসনার স্বরূপ কেমন। মানুষের মনের সঙ্গে শরীরের নিবিড় সম্পর্ক। আর সেটাই প্রাকৃতিক নিয়ম। লোভ, দ্বেষ, মোহ, ঈর্ষা, ভয় ইত্যাদি মানুষের মনকে প্রভাবিত করে। আর সেই প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে না পারলে জগতে কেউ কখনো প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারে না। মনুষ্য মনের আরামদায়ক অনুভূতিকেই সুখ বলা হয়। আর মনের যে কোনো অনুভূতি আরামদায়ক না হলে সেটাকেই দুঃখ, কষ্ট বা বেদনা বলা হয়। বেদনা দুই প্রকারের হয়ে থাকে। শারীরিক এবং মানসিক বেদনা। অনেক সময় শারীরিক বেদনার চেয়ে মানসিক বেদনা বেশি কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে, যা এক সময় মানুষের শরীরকে ধ্বংস করে দিতে পারে। কারণ মনই দেহকে পরিচালনা করে থাকে। বর্তমান বিশ্বে হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি বেড়ে যাওয়ায় দেশে দেশে মানুষের মনে অশান্তি, অস্বস্তি, অস্থিরতা বিরাজমান। আর এই অস্থির, অশান্ত, অসংযত মনের সঙ্গে লোভ, মোহ ইত্যাদি যুক্ত হয়ে ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত তথা দলগত স্বার্থ হাসিলের কামনা, বাসনা মানুষকে উগ্র করে তুলেছে। সারা পৃথিবীতেই মানুষে মানুষে, গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, দলে দলে স্বার্থ হাসিলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশও সেসব অসম, উদ্ভট, অস্বাস্থ্যকর, অশুদ্ধ প্রতিযোগিতার বাইরে নয়। বরং তুলনামূলকভাবে আমাদের দেশে সেই অসুস্থ, অস্থির, অশুদ্ধ প্রতিযোগিতা আরও বেশি। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন সত্তা নিয়ে একটি দেশ ও জাতি যাতে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে সেজন্য বীর বাঙালি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। আর সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রাণ পুরুষ। যদিও আওয়ামী লীগের ইতিহাস বলতে গেলে আরও একজন জননেতা যার নাম না বললে ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যায়, তিনি হলেন, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা ভাসানী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার অবদানও কম নয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানীও স্বাধীনতার জন্য কম ত্যাগ স্বীকার বা কম আন্দোলন সংগ্রাম করেননি। পাকিস্তানিদের তিনিই প্রথম ‘ওয়ালেকুম ছালাম’ জানিয়েছিলেন! বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি, সে সময়ে মওলানা ভাসানীই সারা বাংলায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ প্রজ্বলন করেছিলেন। ছাত্রসমাজের মুখে ‘জ্বালো, জ্বালো আগুন জ্বালো’ স্লোগান তিনিই প্রথম তুলে দিয়েছিলেন। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, পূর্ববাংলা স্বাধীন করো’ এই স্লোগানও তারই তৈরি। পরে যা আমরা ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ বলে উচ্চারণ করেছিলাম। যা হোক, মওলানা ভাসানীর জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো স্লোগানে সারা বাংলা প্রকম্পিত হওয়ায় সে সময়ে আইয়ুব খানের মসনদও নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল এবং একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিশমা এবং আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দক্ষতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ গোহারা হেরেছিল। তারপরের ইতিহাস সবারই জানা। অর্থাৎ পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তর না করা, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণে বাঙালি জাতির যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ইত্যাদি ঘটনা এবং যুদ্ধ জয়ের পর ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, সরকার গঠন ইত্যাদি ঘটনাও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়েছে। এ অবস্থায় স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়ে তোলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে চলেছিলেন, তখন তাকে সে সুযোগ না দিয়ে, এদেশীয় কুচক্রী মহল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ক্ষমতালোভী এ কুচক্রী মহল, যার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিজ দল তথা অত্যন্ত কাছের লোকও ছিল, সেদিন তাদের নিষ্ঠুরতা হালাকু খান, চেঙ্গিস খানের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানিয়েছিল। তাদের উগ্র লোভ-লালসা এতটাই তীব্র ছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা পর্যন্ত মুছে দিতে চেয়েছিল। তাদের অশুদ্ধ, অসুস্থ ও অস্থির মানসিকতা এত ভয়ঙ্কর রূপ পরিগ্রহ করেছিল যে, পরবর্তীকালে তারা জেলখানায় ঢুকে জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করেছিল। কারণ সে সময় তাদের মন বিষাক্ত সাপের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল! অথচ সেদিন তারা যদি মনের সুস্থতা ও শুদ্ধতা রক্ষা করতে পারত তাহলে তাদের দ্বারা এমন জঘন্য ও নিষ্ঠুর কাজ করা সম্ভব হতো না। কারণ আগেই বলা হয়েছে, মানুষের শরীর মন দ্বারা পরিচালিত। তাই শুদ্ধ মনের অধিকারী কোনো মানুষ জঘন্য কোনো কাজ করতে পারে না। অন্যদিকে দূষিত বা খারাপ মনের মানুষরাও কোনোদিন সুখী হতে পারে না। যেমন বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের খুনিরাও সুখী হতে পারেনি, ভালো থাকতে পারেনি। তাদের প্রায় সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলে প্রাণ দিতে হয়েছে। অথচ তারা যদি সুস্থ, সুন্দর জীবনাচার পালন করতেন, তাহলে তাদের এমন পরিণতি হতো না বরং তারা সুখী জীবনযাপন করতে পারতেন আর সে ক্ষেত্রে জাতিরও এত বড় ক্ষতি হতো না। আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাও একটি নিকৃষ্ট জঘন্য কাজের প্রমাণ। সেদিনও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য একটি জঘন্য ও নারকীয় ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। দেশের বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে তিনি গুলিস্তানে সভা করতে গেলে ট্রাকের উপরের বক্তৃতা মঞ্চে উপস্থিত তার ওপর অবিরাম গ্রেনেড চার্জ এবং গুলিবর্ষণ করে যেসব খুনি তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল, তারাও নরকের কীট ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ মনমানসিকতায় যিনি মানুষ, তার পক্ষে এসব করা সম্ভব ছিল না। ২১ আগস্টের সেদিনের ঘটনায় সেখানে উপস্থিত থেকে যে ভয়াবহতা আমি দেখেছি, তা মনে পড়লে এখনো আমার গা শিউরে ওঠে। সে সময় আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ছিলাম। এ অবস্থায় সে সময়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা পরবর্তী পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিয়েছিলেন, আহতদের চিকিৎসা খরচ কীভাবে মিটিয়েছিলেন, তাও আমার জানা। আহত-নিহত নেতাকর্মীদের পরিবার-পরিজনের আর্তনাদে সেদিন আকাশ-বাতাস যখন ভারী হয়ে উঠেছিল, গ্রেনেড হামলায় আহত নারী-পুরুষের আর্তনাদে হাসপাতালে হাসপাতালে যখন কান্নার রোল উঠেছিল, সেদিনও বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রায় একাই সে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। দেশের বর্তমান অবস্থায় আমার এসব কথা বলার উদ্দেশ্য হলো, বর্তমানে সেই বঙ্গবন্ধুকন্যাই দেশের কর্ণধার, দেশের কাণ্ডারি। দেশের সর্বময় ক্ষমতা এখন তার হাতেই। দিনরাত নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। আর এসব কাজ প্রায় একহাতে তিনি নিজেই করে চলেছেন, যা একটি দুরূহ কাজই বটে! এ অবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভুলভ্রান্তিও হতে পারে। আর মানুষ ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বেও নয়। যেমন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত একজন প্রতিমন্ত্রী ভুল ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত হয়েছেন। এক্ষেত্রে সেই প্রতিমন্ত্রী অপসারিত হলেও তার আচার-আচরণ দ্বারা দেশের মানুষের মনমানসিকতার ক্ষতি হয়েছে। একজন প্রতিমন্ত্রী হিসাবে কুরুচিপূর্ণ আচার-আচরণ করে তিনি নিজের প্রতি সুবিচার করতে না পারায় মানুষের কাছে ভুল মেসেজ গিয়েছে। দেশের মানুষ এখন ভাবতে এবং বলতে শুরু করেছেন, তিনি কি একাই, না ক্ষমতার শীর্ষে বা মন্ত্রিপরিষদে আরও কেউ আছেন, যিনি বা যারা তার মতো না হলেও অন্যভাবে সরকার বা সরকারি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করে চলেছেন? অতি সহজে এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না হলেও এ কথা বলা চলে যে, অন্য আরও দু-একজনও আছেন, যারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে চলেছেন। আমি নিজে অন্তত এমন একজনকে চিনি, যার আচার-আচরণ মানুষকে ব্যথিত করে। সেবাপ্রার্থী লোকজন তার কাছে গেলে অনেকের সঙ্গে তিনি এমন ব্যবহার করেন যে, কোনো সভ্য ব্যক্তি তা কল্পনাও করতে পারেন না। তার নাম-পদবি উল্লেখ না করে এখানে এ বিষয়টিও এ কারণে উল্লেখ করা হলো, যাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, তার সরকারে এবং সরকারি দলে আরও অনেকে আছেন, যাদের আচার-আচরণ, কথাবার্তা কৃষ্টি ও সভ্যতাবিবর্জিত। আমরা এসব ব্যক্তিকে সরকার বা সরকারি দলের পদস্থ পর্যায়ে দেখতে চাই না বলেও বিষয়টি বিশেষভাবে এখানে উল্লেখ করা হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গোয়েন্দা বিভাগের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সরকার বা সরকারি দলে এমন ব্যক্তি খুঁজে পেলে তাদেরও অপসারণ করার অনুরোধ জানাই। কারণ অতীতের সরকারে যারা খুনখারাবিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে নরকের কীটরূপে বিবেচিত হয়েছিল, অভিশপ্ত হয়ে তারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। আমরা চাই না বর্তমান সরকারি দলে অশ্রাব্য, কুশ্রাব্য কথা বলা, মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা, মারমুখী আচরণ করা কোনো ব্যক্তির অবস্থান থাকুক। পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ মাত্রই জীবনে সুখ পেতে চায়। আমরা সবাই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে সুখী জীবনের অধিকারী হতে চাই। আর সেজন্যই চেষ্টা করে কেউ এমপি, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, আমলা ইত্যাদি হই। কিন্তু এসব হয়ে বা হতে গিয়ে আমরা যেন অন্যের জানমাল, মান-ইজ্জত ইত্যাদি ক্ষেত্রে একে অপরের হুমকি হয়ে না দাঁড়াই। আপনি যত বড় হতে পারেন, হোন; কিন্তু অন্যকে ছোট করে নয়। আর সেজন্যই আপনাকে শুদ্ধ, সুস্থ, সংযত, সুন্দর মনের অধিকারী হতে হবে। কারণ, আবারও বলছি, মনই মানুষের আচরণ পরিচালনা করে। সুতরাং আসুন আমরা সবাই শুদ্ধাচারে অভ্যস্ত হই। আমরা আমাদের কামনা-বাসনা জানা এবং বোঝার চেষ্টা করি। ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : কবি, প্রাবন্ধিক. কলাামিস্ট